কার্ডিফের মাঠে আশরাফুলের ইতিহাস সৃষ্টি করা সেঞ্চুরি প্রথমবারের মত অজি বধ সবই ঘটেছিল ২০০৫ এ। বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে সেইদিনটি চিরঅম্লান। দেখতে দেখতে এক যুগ এর ও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে মাঝে আছে টেস্ট জয় আছে বহু পরাজয় কিন্তু যতবারই বাংলাদেশ নাম টার পাশে অস্ট্রেলিয়া আসে ততবারই স্মৃতি আমাদের ২০০৫ এ নিয়ে যেতো।

BDVSAUS01 1 - ArenaHype
২০০৫ এ অজিদের বিপক্ষে আশরাফুলের সেঞ্চুরি। ছবি- ESPN

২০০৫ এর অজি বধ কোন পরিসংখ্যান নয় বরংচ ইতিহাস। ইতিহাস মুছবার নয় তবে ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়। গতকাল হার্ট অফ বাংলাদেশ ক্রিকেট মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে আরো একটি নতুন পালক রচিত হলো। আশরাফুলের মহাকাব্যিক ইনিংসের এর মত মুস্তাফিজের ১৯ নম্বর ওভার প্রজন্মভরে আমরা স্মরণ করবো।

২০০৫ এর অস্ট্রেলিয়া এবং ২০২১ এর অস্ট্রেলিয়া টিম যে এক নয় সেটা সুনিশ্চিত। ২০০৫ এর অস্ট্রেলিয়ার পুরো টিম টায় যেন ছিল কিংবদন্তিতে ঠাসা। এরপরও আমরা অজিদের হারিয়েছিলাম টেস্টে। কিন্তু ইতিহাসের সেরা সেই টিমকে হারানোর উন্মাদনা টিম অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারানোর স্মৃতিকে কিছুটা হলেও ফ্যাকাসে করে দিয়েছিল। এবার ও হয়তো বহু ক্রিকেট বোদ্ধা বলবেন টিম অস্ট্রেলিয়া তো আসেনি পুর্ন শক্তির দল হয়ে। আসেনি ওয়ার্নার, স্মিথ কিংবা ম্যাক্সওয়েলের মত সময়ের সেরারা, যারা একাই ম্যাচ শেষ করে আসতে পারেন।

কিন্তু সেটা কি আদৌ কোন অর্থ বহন করে কিংবা আমাদের খুশিতে ভাটা আনে? খেলেননি তো আমাদের সেরারা ও।বাংলার ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম খেলেননি ইনজুরির দরুন। মিস্টার ডিপেন্ডবল মুশফিক খেলেননি নিয়মেরর বেড়াজালে পরে। এছাড়া খেলেননি আরেক ওপেনার লিটন কুমার দাস।

আপাতত বহু হিসেব বাদই দেই, স্টার্ক- মার্শদের সমন্বয়ে গড়া টিম অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ এভাবে গুরিয়ে দেবে সিরিজ শুরুর পুর্বে না আপনি না আমি না কোন ক্রিকেটবোদ্ধা ভেবেছিল। বাংলাদেশ একটা ম্যাচ সান্তনার জয় পাবে সে কথা ভাবতেও তো রসিকতা মনে হতো। বাংলার দামাল ছেলেরা সে রসিকতাকে পরিনত করেছে ইতিহাসে। তাও যেই-সেই ভাবে নয় বরং রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি করে।

প্রথম ম্যাচে বাংলার টি-টুয়েন্টি ইতিহাসে সবচেয়ে কম রান ১৩১ ডিফেন্ড করে জেতার রেকর্ড সৃষ্টি হলো। এর পরের ম্যাচে তো অস্ট্রেলিয়াই করলো আগে ব্যাটিং বাকিটা তো আফিফ নুরুলদের ইতিহাস। তৃতীয় ম্যাচে এসে ভাঙলো প্রথম ম্যাচের রেকর্ড। বাংলাদেশ ডিফেন্ড করলো ১২৭।

২০০৫ হতে ২১ অংকের হিসেবে হয়েছে যেমন বহু পরিবর্তন ঠিক তেমনটাই বাংলার ক্রিকেটের ও হয়েছে বহু পরিবর্তন। আশরাফুল দের সে সময়টা তে বাংলাদেশ খেলতো হারটা যেন হয় সম্মানজনক এই লক্ষ্যে। এই সংস্কৃতি অতিত হয়েছে বেশিদিন নয় ২০১৫ এর বিশ্বকাপ বাংলাদেশ কে পালটে দিয়েছে আমুলে

বাংলাদেশ এখন খেলে একমাত্র জয়ের লক্ষ্যে। এই সময়টায় কিউই দের বাংলাওয়াশ কিংবা ভারত, পাকিস্থান, সাউথ-আফ্রিকাদের ধবলধোলাই সবই করে দেখিয়েছে বাংলার ক্রিকেট। বাদ যায়নি খোদ ক্রিকেটের আদিপুরুষ ইংলিশরা ও। আর জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা, উইন্ডিজ রা তো বহু পুর্বেই হয়েছে বাংলার সহজ শিকার। বাকি ছিল এই একটা দলই ক্রিকেট সম্রাট মাইটি অস্ট্রেলিয়া। কোনভাবেই যেন পারা যাচ্ছিলোনা তাদের হারানো। মাঝে একটা টেস্ট জয় হলেও সিরিজ জয়ের তৃপ্তিটা তো অন্যরকমই বটে। অবশেষে সিদ্ধি হলো সেই অসাধ্য। মাহমুদুল্লাহর লিডারশিপে সাকিব- মুস্তাফিজেরা রচনা করলো ইতিহাস।

প্রথম দুই ম্যাচ জয়ের পর সাহস ছিল বাংলাদেশ জিতবে। কিন্তু টিম অস্ট্রেলিয়া কি এত সহজেই ছাড়তে চাইবে তাদের মাহাত্ম্য। ম্যাচপুর্বেই অস্ট্রেলিয়ার বডি ল্যাংগুয়েজ কিংবা ছোটখাট ব্রিফিং প্রমান করছিল তারা জিততে মরিয়া। প্রথমেই টসে জিতে মাহমুদুল্লাহ এই বৃষ্টিভেজা মাঠে ডিএল মেথডের কথা মাথায় রেখে ব্যাটিং নিলেন। পুরো সিরিজের মত ওপেনিংএ আজো রয়ে গেল একই সমস্যা পারলেন না সৌম্য নাইম কেউই। সাকিব এসে চেষ্টা করছিলেন হাল ধরার মাহমুদুল্লাহর সাথে তার জুটিটা ও জমছিল ভালোই। কিন্তু সাকিব যেন ২৬ এর বাধায় আটকে গেলেন এমন স্লো পিচে আগের ম্যাচের মত ১৭ বলে ২৬ রানের এক কার্যকরী ইনিংস খেলে বিদায় নেন।

BDVSAUS02 - ArenaHype
অ্যাডাম জাম্পাকে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে মিসটাইমড হন সাকিব। ছবি- প্রথম আলো

আফিফ নুরুলেরা ও চেষ্টা করেছিলেন তবে দুইজনই দুর্ভাগ্যজনক রান আউটের শিকার হন। এই দোষ কিছুটা বর্তায় মাহমুদুল্লাহর উপর ও। তবে দ্যা ক্যাপ্টেন মাহমুদুল্লাহ এরপরে এক হাতে যা করেছেন একেবারেই চোখধাঁধানো। ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্যা ফ্রন্ট বলে ক্রিকেটে একটা টার্ম আছে পুরোপুরি যেন তার বহিঃপ্রকাশ ৫২ বলে ৫২ রানের এক সেন্সিবল ইনিংস খেলেন শেষ পর্যায়ে রানের গতি বাড়াতে গিয়ে আউট হয়ে পরেন।

BDVSAUS03 - ArenaHype

এমন বৃষ্টি ভেজা স্লো উইকেটে ভালো ব্যাটিং এর জন্য দরকার ছিল ভালো সঙ্ঘ। কিন্তু কেউই করতে পারেননি সেই কাজ ফলে যা ঘটার তাই ঘটে বাংলাদেশ আউট হয় ১২৭ এ। রেকর্ড গড়ার এই ম্যাচে রেকর্ড করেন এক অস্ট্রেলীয়ও পুরো ম্যাচ বাজে বোলিং করে ও শেষতক তুলে নেন হ্যাট্রিক অভিষিক্ত নাথান এলিস। টি- টুয়েন্টি ইতিহাসে অভিষেক ম্যাচে হ্যাট্রিক এবারই প্রথম।

BDVSAUS04 - ArenaHype
নাথান এলিস দ্যা হ্যাটট্রিক ম্যান।

জয়ের জন্য এক্সপেক্টেড রান থেকে ২০ টা রান যে কম হয়েছে তা সহজেই অনুমেয় তবে ভরসা ছিল ফিজ দের উপর। ম্যাথু ওয়েড বিপক্ষ দলের কাপ্তান মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিং দেখেই হয়তো উজ্জীবিত হয়ে নেমে পড়েন ওপেনিং এ। কিন্তু অজি কাপ্তান যেন বাংলায় এসেছিলেন এক পোড়া কপাল নিয়ে প্রথম ম্যাচের নায়ক , নাসুম তাকে পরিনত করেন শরিফুলের ক্যাচে।

BDVSAUS05 - ArenaHype

প্রথম আঘাতের পরেই বাংলাদেশ সপ্ন দেখতে শুরু করে। তবে বাদ সাধেন মার্শ-ম্যাকডরমেট জুটি শুরু করেন দেখে শুনে খেলা সুযোগ পেলেই বল করছিলেন সীমানা ছাড়া। একটা পর্যায়ে এই জুটির একেকটি রান যেন বাংলার ক্রিকেট ভক্তদের বুকে কাটার মত বিধছিল। বরাবরের মত আবার ত্রানকর্তার ভুমিকায় আর কেউ নয় আমাদের জান আমাদের প্রান সাকিব আল হাসান। ম্যাকডরমেট কে করলেন মাঠ ছাড়া।

BDVSAUS06 - ArenaHype

এরপরে বাকিটা যেন হচ্ছিল সপ্নের মত নাহলে কেইবা জানতো আগের ওভারে মুস্তাফিজের বলে সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেওয়া শরিফুল পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে টানা দুই ওভারে নেবেন দুই উইকেট। এই শরিফুলকে আগের ওভারে চার হাকিয়ে মার্শ করছিলেন স্লেজিং। অজিদের বছরজুড়ে সেরা পারফরম্যার মিচেল মার্শ যেন হয়েছিলেন বাংলাদেশের বুকে কাটার মত তুলে নিয়েছিলেন ফিফটি ও।
অবশেষে স্লেজিং এর চাপ উতরে শরিফুল মার্শ কে পরিনত করেন নাইমের তালুবন্ধি। তার চোখ রাঙ্গানির সেই দৃশ্য আরো একবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাঘের চোখ যেন দেওয়া যায় না ফাকি।

BDVSAUS07 - ArenaHype
শরিফুলের এই চোখ রাঙ্গানির দৃশ্য আরো একবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাঘের চোখ যেন যায় না দেওয়া ফাকি।

এরপরেই শুরু হয় আলেক্স ক্যারিদের প্রতিরোধ সাকিবের এক ওভারে দুই চার ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। এরপরেই আভির্ভাব বাংলার মহানায়ক মুস্তাফিজের ১৭ নম্বর ওভারের পরে ১৯ নম্বর ওভারটা এই ক্রিকেট পাগল জনপদ মনে রাখবে বহু বছর। আশরাফুলের সেই সেঞ্চুরি এবং ফিজের করা ১৯ নম্বর ওভার যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। রান দিলেন মাত্র ১। আর পুরো ৪ ওভারে
রান দিয়েছেন ৯। মডার্ন ক্রিকেটে ২ ইকনমি নিয়ে শেষ করেছেন এটাই বুঝিয়ে দেয় তিনি ছিলেন কততা ভয়ঙ্কর। তিনি যে শুধুই রান দেননি তা নয় তার একেকটা স্লো কার্টার দেখে মনে হচ্ছিল ব্যাটসম্যানদের বুঝি কিছুই করার নেই।

BDVSAUS08 - ArenaHype

শেষ ওভারে রানের প্রয়োজন ছিল ২৩ আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের ছিলোনা টেনশনের কারন
কিন্তু ছিল বোলারের সংকট। মাহমুদুল্লাহ সাকিব দের নিশ্চিত ভাবেই বেগ পেতে হয়েছে কাকে দেবেন বল সেই টেনশনে। শেষতক গ্যাম্বল না করে নিয়মিত বোলার মাহাদির হাতেই দেওয়া হয় বল। মাঝে এক ফ্রিহিটে স্নায়ুচাপ বারিয়ে দিলেও শেষপর্যন্ত নিজের কাজটা সম্পন্ন করেন বেশ ভালোভাবেই।

BDVSAUS09 - ArenaHype
জয়ের আনন্দে আত্মহারা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। জড়িয়ে ধরলেন সাকিবকে।

ব্যাটিং এ মাহমুদুল্লাহ বোলিং এ মুস্তাফিজ পুরো দলকে দিয়েছেন সামনে থেকে নেতৃত্ব। কম যাননি সাকিব, নুরুল, শরিফুল কিংবা আফিফ রা। ম্যাচ সেরার পুরস্কার গিয়েছে ক্যাপ্টেন মাহমুদুল্লাহর কাছে তবে এই জয়ে অবদান ছিল সবার। এই জয় শুধু মাঠে খেলা ১১ ক্রিকেটারের নয় ড্রেসিং রুমে থাকা টুয়েল্ভ ম্যান কিংবা কোচিং স্টাফ সবার এই জয় পুরো বাঙালি জাতির। বহু মতের এই দেশে প্রতিটি ঘটনায় বিভক্ত হয় আমরা শুধু মাত্র ক্রিকেট পারে আমাদের এক কাতারে আনতে ক্রিকেট পারে অফিসের বস থেকে কেরানি সকলকে একই পাল্লায় আনতে। ক্রিকেটের এই অগ্রযাত্রা বলবত থাকু্ক মনেপ্রানে এটাই চায়। বাবা- ছেলে, মা- বোন , হিন্দু- মুসলমানের জাতপাত ভুলে এই একটা জায়গা যেখানে আমরা আনন্দ করি একই সাথে। আনন্দঘন এই মুহূর্তে এ কিংবা বি কিছুই শুনতে চায় না শুধুই চায় আনন্দ ভাগাভাগি করতে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্তরোত্তর মঙ্গল কামনা করি।