১৯৭৮ থেকে ৭৯ সময়কালে সংঘটিত ইরানী বিপ্লব ইতিহাসে ইসলামী বিপ্লব, পারসিয়ান ইনকিলাব ই ইসলামি নামে ও পরিচিত । মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ঘটনা গুলোর মধ্যে অন্যতম এই বিপ্লব।
ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী আড়াই হাজার বছরের পুরনো শাহ রাজবংশের বিলুপ্তি ঘটেছিল এই বিপ্লবের হাত ধরেই। ৭৯ সালের এই বিপ্লব ইরানী সমাজের সকল স্তর কে এক কাতারে এনেছিল। ঐতিহাসিকগন অনেকেই একে রাষ্ট্র বনাম সমাজ এর বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তি সময়ে ক্লাসিক্যাল ইসলামি শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সময়ে ইসলামি বিশ্বের অগ্রগামী অংশ রাষ্ট্র এবং ধর্ম পৃথকের মাধ্যমে বৃহত্তর কল্যান সাধনের চেষ্টা করছিল সেই সাথে একটি বড় এক অংশ পুরনো ধারার শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতি ছিল । এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেন আমেরিকা সহ নেতৃস্থানীয় দেশ গুলো ও ইসলামি বিশ্বে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় মগ্ন ছিল। এরই মধ্যে বেজে উঠে আরেকটি যুদ্ধের ঢোল । শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন পারসিয়ান তেল ব্যবহার করলে ও ইরানিরা খুব কমই লভ্যাংশ পেয়েছিল মাত্র ২০ শতাংশ। যা ইরানি দের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার করলে ও ব্রিটিশ অর্থনীতি কে করেছে সমৃদ্ধ।
সময়ের পরিক্রমায় শাহ রাজাদের পাট চুকিয়ে ৫৩ সালে ইরান জনভোটে নির্বাচিত মোসাদ্দেক কে তাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পায়। তিনি ইরানী স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে সকল তেল সম্পদ কে সরকারি মালিকানায় আনেন যা ব্রিটেন এবং আমেরিকার জন্য মাথাব্যথায় পরিনত হয় এছাড়া তার আর ও অনেক সিদ্ধান্ত পশ্চিমাদের মনপুত হচ্ছিল না।
এরই মধ্যে শেষ রাজা শাহ পাহলবি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। তারই ধারাবাহিকতায় ৬৭ সালে সি আই এ, মোসাদ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় শাহ পাহলবি পুনরায় ক্ষমতার চুড়ায় আরোহণ করেন।
অতীতের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তিনি প্রচন্ড পরিমান পশ্চিমা ঘেঁষা নীতি অবলম্বন শুরু করেন। যা সাধারণ ইরানিদের মাঝে তাকে অ্যামেরিকার পাপেট বা পুতুল স্বীকৃতি এনে দেয়। রেজা শাহ পাহলভি এর শাসনামলে ইরানের সংস্কৃতিগত সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট ও পরিলক্ষিত হচ্ছিল৷ বিশেষ করে তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল ব্রিটিশ ও অ্যামেরিকান কোম্পানি৷
সংস্কৃতিগত অবক্ষয়ে ধর্মপ্রাণ ইরানি মুসলমানদের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধে। সেই সাথে ধর্মীয় গুরুদের অবজ্ঞা করার নীতি ও শিয়া সম্প্রদায়ের নেতাদের বিচলিত করে তুলে। তাই সময়ের সাথে সাথে অন্যোন্য বিরোধী দলগুলোর মত তারা ও প্রত্যাক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে শাহ এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে।
ইমাম খোমেনি নতুন রাষ্ট্রের কনসেপ্টে বিভিন্ন টেপ এবং বই প্রচার শুরু করেন। ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার তেহরানে শাহবিরোধী এক বিশাল জনসমাবেশ হয়৷ সেদিন শাহের বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে কয়েকশ’ বিক্ষোভকারীকে৷ সেই সমাবেশে ৬০-৭০ লাখ জনসমাগম হয়৷ ইরানের বিপ্লবের পর সেই দিনটিকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নাম দেওয়া হয়৷
১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি পালিয়ে যান শাহ৷ এর আগে জনবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ৪ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী শাপর বখতিয়ারকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ঘোষণা করেন৷ শাহ পালিয়ে পরিবারসহ মিশরে চলে যান৷ এবং এভাবেই বিলুপ্তি ঘটে ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ি রাজবংশের।
১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসেই নির্বাসিত খোমেনিকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান শাপর বখতিয়ার৷ ১৫ বছর নির্বাসনে কাটিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরেন খোমেনি৷ সেই সময় বিমানবন্দরে লাখো লোক তাঁকে স্বাগত জানান৷
১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে শাহের ক্ষমতাসীন প্রশাসনকে হটানো হয়৷ সেই সময় ইসলামী বিপ্লবের প্রধান নেতা হিসেবে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন খোমেনি৷ এরপর থেকেই ১১ ফেব্রুয়ারিকে ইরানের বিপ্লব দিবস হিসেবে পালন করা হয়৷
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের মাত্র দুই মাস পর ৩০ মার্চ দেশটিতে এক ঐতিহাসিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই গণভোটের মাধ্যমে ইরানের জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেন৷ সেই সময় ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছিল৷ এরপর ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷