ফুটবলের পরাশক্তি হিসেবে গণ্য হয় ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্সের মতো দলগুলোকে। পরপর দুটি বিশ্বকাপ জয় করেছে এদের মধ্যে শুধুমাত্র ব্রাজিল এবং ইতালি। আর ধারাবাহিকতার দিক থেকে ইউরোপের দলগুলো সবচেয়ে ধারাবাহিক।
গত ৪ দশকের প্রতিটি ফাইনালে ইউরোপীয়ান দলগুলো খেলেছে। ‘৮২ তে ইতালি জার্মানী, ‘৮৬, ‘৯০ তে জার্মানী, ‘৯৪ এ ইতালি, ‘৯৮ এ ফ্রান্স, ‘০২ এ জার্মানী, ‘০৬ এ ইতালি ফ্রান্স, ‘১০ এ নেদারল্যান্ডস স্পেন, ‘১৪ তে জার্মানি, ‘১৮ তে ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়া। প্রতিটি বিশ্বকাপের সমাপনী মঞ্চে ইউরোপীয়ানদের পদচিহ্ন আঁকা। অন্যদিকে ল্যাটিন দলগুলোর মধ্যে ধারাবাহিক দল শুধুমাত্র ব্রাজিল আর্জেন্টিনা। ‘৮৬, ‘৯০, ‘১৪ এর সমাপনী মঞ্চে জায়গা করে নেয় আর্জেন্টিনা এবং ‘৯৪, ‘৯৮,’০২ এ জায়গা করে নেয় ব্রাজিল।
ফাইনালের ফলাফলের দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে ইউরোপীয়ান দেশগুলো। ৪ দশকের ১০ টি ফাইনালের ৭ টি শিরোপা ঘরে তোলে ইউরোপের দেশগুলো। আর বাকি ৩ টি ল্যাটিন দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ৭ টি শিরোপার মধ্যে ‘৮২ ইতালি, ‘৯০ জার্মানী, ‘৯৮ ফ্রান্স, ‘০৬ ইতালি, ‘১০ স্পেন, ‘১৪ জার্মানী এবং সর্বশেষ ‘১৮ এর শিরোপা ঘরে তোলে ফ্রান্স। বিপরীতে ‘৮৬ আর্জেন্টিনা এবং ‘৯৪ ও ‘০২ এর শিরোপা যায় ব্রাজিলের কাছে। ফুটবলের শীর্ষ পরাশক্তি হিসেবে ল্যাটিন দল ব্রাজিল গণ্য হলেও ইউরোপীয়ানদের সঙ্গে কেন তাদের এত ব্যবধান? এমনকি প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দল উরুগুয়ে কেন গত ৪ দশকে সেমিফাইনাল খেলেছে মাত্র ১ টি?
ল্যাটিন ফুটবল আর ইউরোপীয় ফুটবলের মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। ফুটবলের প্রারম্ভিককাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ল্যাটিন দলগুলো শারীরিক শক্তি এবং ব্যক্তিগত দক্ষতাকে কেন্দ্র করে গেমপ্ল্যান করেছে। যার উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম অর্থাৎ সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি ল্যাটিন দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে জন্মগ্রহণকারী। আবার সেরাদের সেরার কাতারের রোনালদো, রোনালদিনহো, গারিঞ্চা, ডি স্টেফানো, রিভালদো, কার্লোস, বাতিস্তুতা এরা সবাই ল্যাটিন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সাফল্য, দক্ষতার দিক থেকে ইউরোপীয়ান দলগুলোর খেলোয়ারদের তুলনায় ল্যাটিন দলের খেলোয়ারেরা অনেক বেশি প্রভাব বিরাজ করতো। অন্যদিকে ইউরোপীয়ান দলগুলো শারীরিক এবং দক্ষতা নির্ভর না খেলে তারা ফুটবলকে মাথা দিয়ে খেলতে শিখেছে। অর্থাৎ তাদের খেলানোর টেকনিক এবং ফিলোসফির মাধ্যমে একক খেলার উপর দলগত খেলাকে প্রাধান্য দিয়ে মাঠে প্রতিটি খেলোয়ারের দায়িত্ব, গুরুত্ব, প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। যার কারণে ব্যক্তিগতভাবে ইউরোপীয়ানরা সর্বকালের সেরাদের কাতারে পৌছাতে না পারলেও সেরাদের সেরার কাতারে বেশ শক্তপোক্তভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছে। জিদান, বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলার, শেভচেঙ্কো, ম্যাথাউস, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, জাভি, ইনিয়েস্তা, ক্রুইফ, ববি চার্ল্টন, প্লাতিনি, পুসকাস, ইউসেবিও, ভ্যান বাস্তেন প্রমুখ যাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য।
সত্তরের দশকের আগে ৯ টি বিশকাপের ৫ টি ছিল ল্যাটিনদের দখলে আর ৪ টি ছিল ইউরোপীয়ানদের দখলে। কিন্তু ৭০ দশকের দিকে স্কটিশ কোচদের পাস নির্ভর ফুটবল স্ট্রাটেজি ইপিএল (তৎকালীন FA Premier League) এ দারুন পরিবর্তন আনে। তখন থেকে লিগে স্কটিশ কোচদের সমাদর বৃদ্ধি পায়। সমস্ত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই টেকনিকাল এপ্রোচ। জার্মান এবং স্প্যানিশরা তখন পাস নির্ভর খেলার প্রচলন শুরু করে তাদের ডোমেস্টিক লিগে। যার ফলস্বরূপ ৪ বছর পর ১৯৭৪ এর শিরোপা ঘরে তোলে জার্মানী। ‘৭৮ এর শিরোপা ল্যাটিন দেশ আর্জেন্টিনার কাছে গেলেও পরবর্তী বিশ্বকাপে ইতালির সলিড ডিফেন্সিভ গেমপ্লের কাছে নতজানু হয় জার্মানী। কিন্তু শিরোপা ঠিকই ইউরোপে চলে যায়। ৯০ এর দশকে এসে ক্রুইফের পজেশন নির্ভর খেলা ইউরোপীয়ানদের টেকনিকালিটিতে এক অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। পজেশন নির্ভর খেলার সঙ্গে টেক্কা দিতে জার্মান কোচদের হাইপ্রেসিং গেম-টেকনিক ইনভেনশন ইউরোপের কোচদের টেকনিকালি আরও সলিড করে তুলে। দেল বস্ক, জোয়াকিম লো, দেশম এর অসাধারণ টেকনিকাল সলিডিটি এবং ভিন্ন চিন্তাধারার গেমপ্ল্যান সর্বশেষ ৩ বিশ্বকাপ পৌছে দেয় ইউরোপে। এভাবে সময়ের সাথে সাথে ইউরোপের দেশগুলোর একেক সময় একেক টেকনিকাল গেমপ্ল্যান এক্সিকিউশনের মাধ্যমে ল্যাটিন দেশের তুলনায় নিজেদের অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
বর্তমান সময়ের ম্যাক্সিমাম ইউরোপের কোচগুলো একাধিক ফিলোসোফি এবং স্ট্রাটেজি ফলো করে যাতে যেকোন সময় যেকোন দলকে যেকোন স্ট্রাটেজির বিরুদ্ধে পরাজিত করতে পারে। এক্ষেত্রে সিটব্যাক, বাসপার্ক, হাইপ্রেস, হাইলাইন ডিফেন্স, পজেশন বেসড গেম ইত্যাদি নানা রকম স্ট্রাটেজির আশ্রয় নেয় কোচেরা। উদাহরণস্বরূপ ২০২০ ইউরোর সেমিতে ইতালি-স্পেন ম্যাচে সময়ের অন্যতম সেরা স্প্যানিশ মিডকে নিউট্রালাইজ করতে মানচিনি আশ্রয় নেয় ক্লাসিকাল ইতালিয়ান ডিফেন্সিভ সিটব্যাক। অথচ পুরো ট্যুরনামেন্ট জুড়ে মানচিনির দল ক্লাসিক ইতালিয়ান গেমপ্লে না খেলে অসাধারণ কাউন্টার-প্রেসের মাধ্যমে বেশ সুন্দর খেলা উপহার দিচ্ছিল। কিন্তু সময়ের অন্যতম সেরা মিডফিল্ড এর বিরুদ্ধে কোনধরনের রিস্ক না নিতে চেয়ে তার সিটব্যাক খেলার পাশার দান পালটে দেয়।
ল্যাটিন দেশগুলো এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল এ দিকে খানিকটা উন্নতি করলেও উরুগুয়ে, চিলি, প্যারাগুয়ে, কলম্বিয়া, পেরু ইত্যাদি ল্যাটিন দেশগুলো এখনো পূর্বেএ মতো শারীরিক শক্তি নির্ভর খেলা চালিয়ে আসছে। এতে খেলোয়াড়দের ইঞ্জুরির রিস্ক বাড়ে। একই সঙ্গে এ দলগুলো ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে না। ল্যাটিন দেশগুলো থেকে অনেক মানসম্মত খেলোয়াড় ইউরোপে এসে ইউরোপের ক্লাবগুলোয় অসাধারণ খেলা প্রদর্শন করে জাতীয় পর্যায়ে নিজ দেশে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। কারণ ইউরোপের টেকনিকাল গেমপ্ল্যানের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ফিজিকাল গেমপ্ল্যানের বিরুদ্ধে টেকনিকালি কলাপ্স করে প্লেয়াররা। যার ফলস্বরূপ রেজাল্টের দিক থেকে ল্যাটিনরা অনেক পিছিয়ে। এজন্যই উরুগুয়ে গত ৪ দশকে মাত্র ১ টি সেমিফাইনাল খেলেছে। কারণ বেশিরভাগ ল্যাটিন দলগুলো আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ। এক মহাদেশের উত্থান এবং অপরদিকে আরেক মহাদেশের পতন। ২০২২ বিশ্বকাপে কি ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের পুনরাবৃত্তি হবে? নাকি ল্যাটিন দেশগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে শিরোপা গত ২০ বছরের মধ্যে ব্রাজিলের পর প্রথমবার শিরোপা ঘরে তুলবে?