ফুটবল জগতে যদি প্রবেশ করতে হয়, তাহলে যাদের নাম স্মরণে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন লিওনেল মেসি। তিনি আধুনিক প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে স্বীকৃত।

লিওনেল মেসির বেড়ে ওঠার গল্পঃ

লিওনেল মেসি কৈশোর জীবন | Lionel Messi Childhood

লুইস লিওনেল আন্দ্রেস মেসি (সংক্ষেপে “লিও”) আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে ১৯৮৭ সালের ২৪ শে জুন একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কারখানার শ্রমিক এবং মা ক্লিনার ছিলেন। তিনি অল্প বয়স থেকেই ফুটবল খেলা শুরু করেন এবং তাঁর প্রতিভা শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে উঠে সকলের কাছে। ৮ বছর বয়সে, তিনি রোজারিও কেন্দ্রিক ক্লাব নেওয়েলস ওল্ড বয়েজের যুব দলে যোগদানের জন্য নিয়োগ পান। তবে, ১১ বছর বয়সে লিওনেল মেসির গ্রোথ হরমোন(জিএইচডি) এর ঘাটতি ধরা পড়ে। এটি এমন একটি সমস্যা যা তাঁর বৃদ্ধিকে স্তিমিত করে এবং এর সমাধানের জন্য ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন যা মেসির পরিবারের জন্য ছিল অসম্ভব। সেখানকার স্থানীয় ক্লাব রিভার প্লেট মেসিকে স্বাক্ষর করতে আগ্রহী হলেও তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থ দিতে রাজি হয়নি।

সৌভাগ্যক্রমে ১৩ বছর বয়সে, মেসিকে ফুটবল পাওয়ার হাউজ এফসি বার্সেলোনার যুব একাডেমী (লা মাসিয়া) তে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয় এবং কোচ কার্লস রেক্সাচ মুগ্ধ হন এবং লিওনেল মেসিকে একটি চুক্তি প্রদান করেন (একটি কাগজের ন্যাপকিনে লেখা!) যার মধ্যে মেসির চিকিৎসার জন্য অর্থ প্রদান করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। বার্সেলোনার এই বৃহৎ সহযোগিতা পরিশোধ করার জন্য মেসি ধীরে ধীরে তাদের উপহার দিতে থাকেন । শুরু হয় বার্সেলোনার হয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলার মেসির রাজত্ব ।

লিওনেল মেসির ক্লাব ক্যারিয়ারঃ

১৬ বছর বয়সে, লিওনেল মেসি এফসি বার্সেলোনার হয়ে অভিষেক করেন এবং ২০০৪/২০০৫ মৌসুমে প্রথম গোল করে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে নিজেকে রেকর্ড বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০০৬/২০০৭ মৌসুমে মাত্র ২০ বছর বয়সে মেসিকে ফার্স্ট চয়েজ স্ট্রাইকার বানানো হয় ও দলের হয়ে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন যেখানে লিগের ২৬ খেলায় ১৪ টি গোল করেছেন। মেসির সবচেয়ে সফলতার মৌসুম ছিল ২০০৯/২০১০ যেখানে তিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ জয় করেন। একই মৌসুমে, তিনি সর্বপ্রথম ফিফা ব্যালন ডি’অর অর্জন করেন। তিনি ২০১২ সালে একটি ক্যালেন্ডার বছরে সর্বাধিক গোলের সর্বকালের বিশ্ব রেকর্ডটি ভেঙে ফেলেন যেখানে তার গোলসংখ্যা ছিল ৯১টি। সেসময় লিওনেল মেসি অনেক ক্লাবে যাওয়ার ওফার পেলেও তিনি রিজেক্ট করেন ।

২০১৪/২০১৫ মৌসুমে লিওনেল মেসি লা লিগায় সর্বকালের সেরা স্কোরার হয়ে বার্সেলোনাকে একটি ঐতিহাসিক দ্বিতীয় ট্রিবলের দিকে নিয়ে যান । ২০১৬ সালে পেনাল্টি কিক থেকে মেসি সুয়ারেজকে সহায়তা করেন। কেউ কেউ এটিকে “প্রতিভা স্পর্শ” হিসাবে দেখেন। এছাড়াও ২০১৭ সালে বার্সেলোনার হয়ে মেসি তার ২৭তম ফ্রি-কিক গোল করেন যা ক্লাবের সর্বকালের সর্বোচ্চ ফ্রি কিক স্কোরার হিসাবে কোম্যানকে ছাড়িয়ে যান।২০১৮/২০১৯ মৌসুমে মেসি বার্সেলোনার অফিশিয়াল ক্যাপ্টেন হন এবং ওই বছরই ক্যাপ্টেন হয়ে লা লিগা ট্রফি জিতেন। ২০১৯/২০২০ মৌসুমে তার সপ্তম পিচিচি ট্রফি অর্জন করেন ও জারার কে ওভারটেক করেন। যদিও সে মৌসুমে মেসি তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ পরাজয়ের মুখোমুখি হন বায়ার্ন মিউনিখ বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলে হারানোর পর। ২০২০ সালের আগস্টের দিকে মেসি বার্সেলোনা ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন ক্লাবের খারাপ ম্যানেজমেন্ট এর জন্য । কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে শেষমেশ লিওনেল মেসি ক্লাবে রয়ে যান।২০২০সালে মেসি বার্সেলোনার হয়ে ৬৪৪ তম গোলটি করেন ও একটি ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করা পেলেকে ছাড়িয়ে যান। একই বছরে তিনি ক্লাবের হয়ে ৭৬৮তম ম্যাচ খেলে জাভি থেকে এগিয়ে যান। আশা করা যায় তিনি সামনের দিনগুলোতে আরো রেকর্ড ব্রেক করবেন ।

লিওনেল মেসির ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার:

আর্জেন্টাইন-স্পেনীয় নাগরিক হিসেবে ২০০৪ সালে মেসিকে স্পেনের অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল দলে খেলার জন্য ডাকা হলেও মেসি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০০৪ সালের জুনে, আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব ২০ দলের হয়ে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে প্রথম প্রীতি খেলায় মাঠে নামেন।২০০৫ সালে ফিফা যুব চ্যাম্পিয়ন কাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয় এবং তিনি ৬টি গোল করে প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল এবং গোল্ডেন বুটের পুরস্কার জিতেন। মজার ব্যাপার হলো ২০০৫ সালের ১৮ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে সিনিয়র দলে মেসির অভিষেক হয় ও সেই ম্যাচে লিওনেল মেসি লাল কার্ডের স্বীকার হয়। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে মেসি আর্জেন্টিনার সর্বকনিষ্ঠ এবং ইতিহাসের ৬ষ্ঠ কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন । এছাড়াও মেসি ২০০৭ সালের কোপা আমেরিকার কনিষ্ঠ সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৮ সালের অলিম্পিক এ আর্জেন্টিনার হয়ে স্বর্ণপদক জিতেন।

২০১০ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার গোল্ডেন বল পুরষ্কারের জন্য ১০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় মেসি জায়গা করে নেন। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ৩৬তম গোল করে ম্যারাডোনা ও ক্রেসপোরকেও ছাড়িয়ে যান তিনি। মেসির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ। তিনি ক্যাপ্টেন হয়ে আর্জেন্টিনা কে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যান । দুর্ভাগ্যবশত আর্জেন্টিনা কিছু গোলের সুযোগ হাতছাড়া করে। অতিরিক্ত সময়ে একটি গোল খেয়ে পরাজিত হতে হয় । বিশ্বকাপ না জিতলেও লিওনেল মেসিকে প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করা হয়।ক্যাপ্টেন হয়ে তিনি ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেললেও ট্রফি ছুঁতে পারেন নি । ২০১৮ সালে মেসি জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন, তবে কয়েক মাস পরেই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে পুনরায় জাতীয় দলে ফিরে আসেন ।

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা তেও লিওনেল মেসি ট্রফির দেখা পান নি । তবুও মেসি এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা গ্রুপ কোয়ালিফাই করেছে । চিলির সাথে মেসির ফ্রি কিক গোলের মাধ্যমে রোনালদোর ৫৬টি ক্যারিয়ার ফ্রি কিকের মাইলফলক উত্তীর্ণ করেন। এই কোপা ও ২০২২ সালের বিশ্বকাপ হয়তো তার শেষ চেষ্টা । তিনি ক্লাব থেকে অনেক ট্রফি জিতলেও আর্জেন্টিনার হয়ে কোনো মেজর ট্রফি জিততে পারেন নি।
আশা করা যায় তিনি অবসর গ্রহণ করার আগে অন্তত একটি ট্রফি জিতবেন।

একই খেলার ধরন ও দৈহিক উচ্চতার কারণে মেসিকে দিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করা হয়। লিওনেল মেসি অন্যান্য খেলোয়াড়দের তুলনায় অধিক ক্ষিপ্র এবং তিনি অতি দ্রুত গতিপথ পরিবর্তন করতে পারেন। এছাড়াও তিনি কৌশলে ট্যাকল এড়িয়ে যেতে পারেন।প্রাক্তন বার্সেলোনা ম্যানেজার পেপ গার্দিওলা বলেন,

‘‘মেসিই একমাত্র খেলোয়াড় যে বল ছাড়া যত দ্রুত দৌড়াতে পারে, বলসহ তার চেয়েও বেশি দ্রুত দৌড়াতে পারে।’’

– পেপ গার্দিওলা

লিওনেল মেসিকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী ফুটবলাররা প্রশংসা করেন প্রতিনিয়তই।

“তাঁর (মেসি) সম্পর্কে লিখবেন না, তাঁকে বর্ণনা করার চেষ্টা করবেন না। কেবল তাঁকে দেখুন”

– পেপ গার্দিওলা

“আমার জন্য, মেসির খেলা দেখা একধরনের আনন্দ – এটি একটি প্রচণ্ড উত্তেজনা থাকার মতো এবং অবিশ্বাস্য আনন্দ।”

– লুইস ফিগো

“আমি এখন পর্যন্ত তাঁকে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে দেখেছি । আপনি সর্বদা বিশেষ কিছু প্রত্যাশা করেন এবং আমি অবশ্যই বলব যে মেসি আপনাকে কখনও হতাশ করবে না! তিনি কোনও স্পোর্টস ম্যান নন তিনি একজন শিল্পী!”

– আর্সেন ওয়েঙ্গার

“আমি সেই খেলোয়াড়কে দেখেছি যিনি আর্জেন্টিনা ফুটবলে আমার স্থান অধিকার করবেন এবং তার নাম মেসি। মেসি একজন বুদ্ধিমান।”

– দিয়েগো ম্যারাডোনা

“আমি কেবল মনে করি মেসি আমার চোখে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ।”

– ওয়েইন রুনি

“আমি মেসিকে অনেক পছন্দ করি, তিনি একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড়। ব্যবহারগতভাবে, আমরা কার্যত একই স্তরে আছি।”

– পেলে

“মেসির ডান পা দরকার নেই। তিনি কেবল বাম পা ব্যবহার করেন এবং তিনি এখনও বিশ্বের সেরা । ভাবুন তিনি যদি তার ডান পাও ব্যবহার করতেন, তবে আমাদের জন্য গুরুতর সমস্যা হতো।”

– জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ

“মেসি কি আসল খেলোয়াড় না প্লেস্টেশনের ক্যারেক্টার?”

– রাদামেল ফালকাও

“তিনি (লিওনেল মেসি) আমাদের মতো মানুষ কিনা তা নিশ্চিত করতে আমাকে মেসিকে স্পর্শ করতে হয়েছিল।”

– জিজি বুফন

“ফুটবল বিশ্বের জন্য লিওনেল মেসি একটি সম্পদ। কারণ তিনি বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য রোল মডেল… মেসি হবেন ইতিহাসের সর্বাধিক ব্যালন ডি’ অর জয়ের প্লেয়ার। তিনি পাঁচ, ছয়, সাতবার জিতবেন। তিনি তুলনামূলকভাবে ভিন্ন “

– জোহান ক্রুইফ

মেসি পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে দুর্বল শিশুদের উদ্দেশ্যে দাতব্য প্রচেষ্টায় জড়িত আছেন । মেসি ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত ও এক্টিভ সদস্য হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও মেসি তার নিজস্ব দাতব্য সংস্থা, “লিও মেসি ফাউন্ডেশন” প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং খেলাধুলায় অ্যাক্সেস সমর্থন করে।

মেসি তাঁর জীবনে অনেক ট্রফি অর্জন করেছেন । একনজরে তার উল্লেখযোগ্য অর্জন দেখে নেওয়া যাক :

  1. 1x The Best FIFA Men’s Player
  2. 6x Winner Ballon d’Or
  3. 3x UEFA Best Player in Europe
  4. 5x Golden Boot winner
  5. 4x UEFA Champions League winner
  6. 3x FIFA Club World Cup winner
  7. 10x La Liga champion
  8. 21x Top scorer
  9. 10x Player of the Year
  10. 3x UEFA Supercup winner
  11. 1x All-time leading scorer
  12. 7x Copa Del Rey winner
  13. 8x Spanish Super Cup winner
  14. 8x Pichichi Trophy
  15. 6x La Liga Best Player

মেসি ক্লাব হয়ে অনেক কিছু অর্জন করলেও তিনি চান নিজের দেশকে উপহার দিতে। তাঁর একটি আন্তর্জাতিক অর্জন খুবই দরকার। এক কনফারেন্সে মেসিকে ৫টি ব্যালন ডি’অর ও ১টি বিশ্বকাপ এই দুটির মধ্যে বাছাই করতে বলা হলে তিনি ১টি বিশ্বকাপকেই বেছে নেন। পৃথিবীতে মেসির ভক্তের অভাব নেই । সবাই চায় মেসি আরো খেলুক , দর্শকদের আরো কিছু উত্তেজনাপূর্ণ খেলা পরিবেশন করুক। কিন্তু সময় কারোর জন্য অপেক্ষমান নয় । একসময় এই কিংবদন্তী অবসর গ্রহণ করবেন।

আজ তার ৩৪তম জন্মদিন । শুভ জন্মদিন লিও!!!

সামনের বছরগুলোতে আরো ভালো খেলবে এই ভরসা সকলের মধ্যে বিদ্যমান। লিও এগিয়ে যাও , সকল মানুষকে মুগ্ধ কর । আমাদের সাপোর্ট সবসময় রয়েছে।