ক্লাসের ফার্স্ট হওয়া ছেলেটা যখন খারাপ করতে থাকে তখন কথা উঠতেই থাকে। কাঁটাছেড়া চলতে থাকে তার আচরণ। এমনকি সে যখন ভালো করে তখনও তাকে নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ চলতেই থাকে। কখন কি করল, কোথায় গেল কার সাথে মিশলো ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে । তেমনই ১৭ কোটি বাঙালির ফার্স্ট বয় সাকিব আল হাসান। পুরো ক্রিকেট পাড়াতেই তাঁকে নিয়ে চলে গুঞ্জন, আলোচনা, সমালোচনা।টেস্ট না খেলে আইপিএল খেলা বা পিএসএলে ডাক পেয়েও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলা এগুলো এখন পুরোনো। গত ২৪ ঘন্টায় মোহামেডান ও আবাহনীর ম্যাচে সাকিবের আচরণ নিয়েই চলছে আলোচনা সমালোচনা।
ম্যাচের শুরুতে মোহামেডান ব্যাট করে ১৪৪ রান সংগ্রহ করে। এরপর পরই মাঠে মেঘ ঘনিয়ে আসতে থাকে।আবাহনী ব্যাটিং করতে নামলে প্রথমেই ২ টা উইকেট হারিয়ে বসে। এরপর অধিনায়ক সাকিব বল করতে এসে ঘটে প্রথম ঘটনা। মুশফিকের নিশ্চিত এলবি এর আবেদন নাকচ করে দেন আম্পায়ার।এতে আম্পায়ার ইমরান পারভেজ সিদ্ধান্ত নিতে কোন সময়ও নেন নি যে পুনর্বিবেচনা করে দেখা যায় কিনা। আর তাতেই ক্ষেপে গিয়ে সাকিব স্টাম্পে লাথি মারেন ।

এমন ঘটনা আর দেখতে চান না সিসিডিএম-প্রধান।

যেন তিনি বুঝতেই পেরেছিলেন এমন কিছু একটা হতে পারে। আবার ৫ওভার বল হয়ে গেলে টিটোয়েন্টিতে ডিএলএস পদ্ধতিতে খেলার ফলাফল দেয়া যায়। যা আগের নিয়মে ৬ ওভার ছিল। ৬ ওভার হতে তখন মাত্র ১ বল বাকি। এমন সময় বৃষ্টি শুরু না হতেই আম্পায়ার মাহফুজুর রহমান খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেন। আর তাতেই রেগে গিয়ে সাকিব স্টাম্প তুলে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারেন। এরপর আবার আবাহনীর ম্যানেজার সুজনের সাথেও বচসায় জড়িয়ে পড়েন । যদিও এর পর ডিএল পদ্ধতিতে মোহামেডান জয় লাভ করে ৩১ রানে।
এমন কান্ড এর আগে উইন্ডিজ তারকা পেসার হোলডিং ১৯৮০ সালে টেস্টে নিউজিল্যান্ডের.বিপক্ষে করলেও তখনকার নীতিতে এটির ব্যাপারে কিছুই ছিল না। ফলে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।


কিন্তু ম্যাচে সাকিবের কর্মকান্ড নিয়ম ও আচরণবিধির পরিপন্থি হলেও সমালোচনার পরিবর্তে সাকিব মানুষের সমর্থনই পাচ্ছেন। এর আগেও আচরন এর কারনে সাকিব নিষেধাজ্ঞা এবং জরিমানা এর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে তার এই কর্মকান্ডের জন্য তিনি ফেসবুকে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এখন তার শাস্তি হিসেবে কি হবে তার ব্যাপারে বিসিবির পরিচালক ও সিসিডিএম–প্রধান কাজী ইনাম আহমেদ আজ বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে ম্যাচ রেফারি, আম্পায়াররা একটা প্রতিবেদন দেবে। এখানে নিয়মনীতি যা থাকার, সবই আছে। নিয়ম ভাঙলে কী হয়, সেটাও সবাই জানে। যে প্রতিবেদনই আসুক, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করব।’
সিসিডিএম–প্রধান আরও বলেন, ‘ম্যাচের মধ্যে অনেক সময় ক্রিকেটাররা উত্তেজিত হয়। তবে আমরা অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের কাছে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারটি প্রত্যাশা করি। আমি নিজেও ছোটবেলা থেকে আবাহনীর সমর্থক। আবাহনী-মোহামেডান খেলা মানেই উত্তেজনা। তবে আজ মাঠের মধ্যে যা দেখেছি, তা হতাশাজনক। এখানে যারা খেলছে, সবাই পেশাদার ক্রিকেটার, অনেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। আমরা এমন উদাহরণ দেখাতে চাই না।’
তবে এর আগেও দেশীও ক্রিকেটে এবং এবারও মান নিয়ে সমালোচনা চলছেই। এবার তো ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ উঠেছে এবং সেই ম্যাচের ভিডিও ক্লিপ সোস্যাল মিডিয়াতে ঘুরছেই ।এর আগেও আম্পায়ার দিয়ে ম্যাচে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আছে । বাজে আম্পায়ারিং এর ও অভিযোগ বহু দিনের। অনেকের মতে এমন চলতে থাকলে দেশের ফুটবলের মত ক্রিকেটও মুখ থুবড়ে পড়বে। ফলে মানুষ সাকিবের এই অপেশাদার আচরণকেই সমর্থন দিচ্ছে।তবে অনেক সাবেক খেলোয়াড়ই এটি নিয়ে সাকিবের সমালোচনা করেছেন।গাজী আশরাফ, ‘পর্দায় যা দেখেছি, সেটা হতে পারে না। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে পরপর দুটি ঘটনা…এটা আমাকে খুবই ধাক্কা দিয়েছে। একটা ভুল করলে সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি হয়। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আরেকটা ভুল। এটার ভেতরে কিছু আছে কি না বোঝা যাবে। তবে যা দেখেছি, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

সাকিব নিজেই স্টাম্প উপড়ে ফেলেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের কালো দিনের মতো।’গাজী আশরাফ অবশ্য ঘরোয়া ক্রিকেট কীভাবে চলছে, এখানে আম্পায়ারিংয়ের মানই বা কেমন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কী ঘটনা থেকে সাকিব এটা করল সেটাও জানার অপেক্ষায় আছি। আমরাও সার্বিকভাবে দেশের ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখি। দেশের ক্রিকেট কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, আম্পায়ারিং কীভাবে হচ্ছে, কেমন হচ্ছে; সেখান থেকেই সাকিবের এই বিস্ফোরণ কি না সেটা জানতে চাইব।’নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক অধিনায়ক বলছেন এই ঘটনার বৃহৎ প্রভাবের কথা। সাকিবের মতো তারকা ক্রিকেটারের এমন অক্রিকেটীয় আচরণ তিনি মানতেই পারছেন না, ‘এমন চিত্র মাঠে কখনো দেখিনি। খুবই দুঃখজনক, খুবই কলঙ্কময় ঘটনা। আমি খুবই হতাশ হয়েছি সাকিবের এই ঘটনায়। সাকিব তো একজন রোল মডেল। তাকে দেখে তো আগামীর ক্রিকেটারদের শেখার কথা। কী শিখবে বলুন? সে একজন আন্তর্জাতিক তারকা, সে ব্র্যান্ড। তার তো বোঝা উচিত। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিসিবির অনেক পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এমন কি ২০১৯ সালে সাকিবের নিষেধাজ্ঞাটি এড়ানো সম্ভব হলেও বিসিবি এর পক্ষে কোন ব্যবস্থাই নেয় নি। কারন ছিল ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে আন্দোলনে কোয়াবের প্রতি সমর্থন জানানো।
বৃষ্টি শেষে অবশ্য ভিন্ন সাকিবকেই দেখা গেল। প্রতিপক্ষ দলের মুশফিক, মোসাদ্দেক ও অন্যান্য ক্রিকেটারের সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখা যায় সাকিবকে। যে আম্পায়ারের সঙ্গে একটু আগেই ঝামেলায় জড়ান, তাঁদের সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলছিলেন তিনি। সেই হাসিটা খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত।

উত্তেজনা শেষে প্রতিপক্ষ দলের  ক্রিকেটারদের সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখা যায় সাকিবকে।

বৃষ্টিতে আবাহনীকে ৯ ওভারে ৭৬ রানের নতুন লক্ষ্য দিলে ৪৪ রানে থামে আবাহনীর ইনিংস, ফলে মোহামেডান জেতে ৩১ রানে।

যে আম্পায়ারের সঙ্গে একটু আগেই ঝামেলায় জড়ান, তাঁদের সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলছিলেন সাকিব।


আর এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে যখন ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা ফুটে উঠছে তখন অনেকেই বলছেন সাকিব ভুল করলেও এই লাথিটা ছিল ঠিক দেশের ক্রিকেট সিস্টেমের উপর।
সৌজন্যেঃপ্রথম আলো ও অন্য বেশ কিছু মিডিয়া।