লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করা একটা বল মুহুর্তের মধ্যে আচমকা এক টার্ন এ ব্যাটসম্যান এর অফ স্ট্যাম্প তছনছ করে দেওয়ার দৃশ্যটা বোধহয় ক্রিকেট পাড় সমথর্কদের জন্যও একসময় ছিলো অকল্পনীয়। কিন্ত বাস্তবতা যে কল্পনার জগতের চেয়েও বড় তা প্রমাণ করে দিয়ে এমনই এক বল করেছিলেন শেন ওয়ার্ন যা আমাদের সকলের নিকট বল অব দ্যা সেঞ্চুরি নামে পরিচিত।
শেন ওয়ার্ন টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট এর মালিক এর বলটি কতটা অসাধারণ ছিলো তা সম্ভবত লিখে বিস্তারিত আকারে বর্ণণা করা সম্ভব নয়। ইংল্যান্ডের পিচে ইংলিশ ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিং কে করা বলটির টার্ন ডিগ্রি ছিলো প্রায় ৯০ ডিগ্রী। মূলত শেন ওয়ার্ন একজন লেগ স্পিনার ছিলেন।
ক্রিকেট ইতিহাসে যদি একটু ঘেটে আসি তাহলে দেখতে পারবো যে ক্রিকেটে আগে একটা সময় শুধুমাত্র পেস বোলারেই সীমাবদ্ধ ছিলো। পেস বোলারদের গতি বাউন্স সুইয়েংর মাধ্যমেই ক্রিকেটের সৌন্দর্য খুজে পাওয়া যেতো। কিন্তু শেন ওয়ার্ন ক্রিকেটপ্রেমীদের বুঝিয়েছেন একজন ভালো লেগ স্পিনার যখন ভালো টেকনিক্যাল ব্যাটসম্যান কে বল করতে আসে সেই ব্যাটেল টাও কতোটা সুন্দর হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি ভেবে থাকেন লেগ স্পিনারদের পথচলাও শুরু হয়েছে শেন ওয়ার্নের হাতে তাহলে আপনার ধারণা টা ভুল। শেন ওয়ার্নের পূর্বেও লেগ স্পিনার হিসেবে ভারতের সুভাষ গুপ্তে, চন্দ্র শেখর,অনিল কুম্বলে, অস্ট্রেলিয়ার বিলি ও’রেয়ালি,রিচি বেনো, পাকিস্তানের আবদুল কাদির সহ বেশ কিছু নাম আসবে। এর মধ্যে অনিল কুম্বলের কথা আলাদা ভাবে না বললেই নয়। অন্যান্য লেগ স্পিনারদের মত বিশাল বিশাল টার্ন না পেলেও নিজের শক্তির জায়গাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যাটসম্যানদের জন্য হয়ে উঠতেন ভয়ের কারণ। নিখুত লাইন লেংথ এর সাথে বাউন্সের মিশ্রণেই আজ তিনি টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
Image Source : OrissaPost, Times Now, Mashable Pakistan
লেগ স্পিনারদের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে তাদের ফিংগার স্পিনারদের মতো বল টার্ন করাতে তেমন একটা পিচের সহায়তার প্রয়োজন হয় নাহ। মূলত লেগ স্পিনার রা কব্জির মোচড়ে তাদের বলগুলো রিলিজ করে থাকেন। ডান কব্জির মোচড়ে বল করতে পারা স্পিনারদের রাইট আর্ম লেগ স্পিনার বলা হলে বাম হাতে কব্জির উপর নির্ভর করা বোলার দের বলা হয় চায়নাম্যান। একজন লেগ স্পিনার যখন স্বাভাবি ভাবে বল করেন সাধারণত তার বলগুলো ডান সাইডে পিচ করে বাম দিকে টার্ন করে থাকে। একজন লেগ স্পিনার সাধারণত বেশিরভাগ সময় লেগ ব্রেক ই করে থাকে। কিন্তু সময়ের চাহিদায় লেগ স্পিনার রা এখন লেগ ব্রেক, গুগলি, টপ স্পিন, ফ্লিপার মত ডেলিভারি গুলো যুক্ত করেছেন নিজেদের তূর্ণে।
গুগলি মূলত লেগ ব্রেকের বিপরীত। লেগ স্পিনার রা যখন সাধারণত অফ ব্রেক করে থাকেন সেটাই গুগলি হিসেবে পরিচিত।১৯০৩ সালে গুগলি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন সাবেক ইংলিশ লেগস্পিনার বানার্ড বোসানকোয়েট। লেগব্রেক আর গুগলির গ্রিপ একই থাকলেও রিস্ট পজিশন ও রিলিজ পয়েন্ট টা আলাদা হয়ে থাকে। ট্রেডিশনাল ফ্রন্ট অফ দ্যা হ্যান্ডের পরিবর্তে ব্যাক অফ দ্যা হ্যান্ড এর মাধ্যমে রিলিজ করা হয়ে থাকে।
Image Source : CRICKETERS HUB
অন্যদিকে টপ স্পিনের কথা বলতে গেল এই বল সাধারণ টার্ন কম হয়ে থাকে এবং বাউন্স টা একটু বেশি থাকে। টপ স্পিনে সাধারণত বলে সাইড স্পিনের তুলনায় ওভার স্পিন বেশি হয়ে থাকে। অনিল কুম্বলের অন্যতম অস্ত্র ছিলো এই টপ স্পিন।
ফ্লিপার রিস্ট স্পিনাদের ভ্যারিয়েশন গুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল। ফ্লিপারের মাধ্যমে ব্যাটসম্যান এব্লিডব্লু ও বোল্ড হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত ফ্লিপার ডেলিভারি গুলো পিচে পড়ার পর কিছুটা লো হয়ে যায় এবং স্কিড করে থাকে বেশি। শেন ওয়ার্ন অন্যতম উইকেট টেকিং ডেলিভারি ছিলো এই ফ্লিপার।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে লেগ স্পিনার এর কথা বলতে গেলে সবার আগে যেই নামটি চলে আসবে তিনি আফগান তারকা রশিদ খান। রশিদ খান এর ডেলিভারি গুলো কে প্রায় সময়ই রিড করা যায় না যার ফল স্বরুপ ব্যাটসম্যান রা এটাক করতে গেলে এব্লিডব্লু বা বোল্ড এর শিকার হয়ে থাকেন। সচারচর লেগ স্পিনার রা উইকেট শিকার করলেও কিছুটা খরুচে হয়ে থাকেন কিন্তু রশিদ খানের বেলায় জিনিস টা আলাদা তিনি উইকেট তুলার সাথে সাথে ইকোনমিক্যাল ও থাকছেন। কারণ তিনি তার কব্জির মোচড়ে অনেক স্পিডে করেন যার কারণে ব্যাটসম্যান দের পক্ষে তার বল রিড করা বেশ কষ্টসাধ্য। এছাড়াও তিনি কুইকার ডেলিভারি করে থাকেন। লেগ ব্রেক আর গুগলির ক্ষেত্রেও তিনি কুইকার করে থাকেন। মূলত ৯০ কি.মি এর বেশি গতিতে যে লেগ ব্রেক, গুগলি করা হয় তাই হচ্ছে কুইকার। বর্তমান সময়ে রশিদ খানের পাশাপাশিও লেগ স্পিনার হিসেবে আলো ছড়াচ্ছেন ভারতের চাহাল, অস্ট্রেলিয়ার জাম্পা, শ্রীলংকার হাসারাংগা, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির, পাকিস্তানের শাদাব খান সহ আরো অনেকে।
Image source : espncricinfo, Cricket Addictor, myKhel
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আসলেই দেখা যায় লেগ স্পিনের দৈন্যদশা। বাংলাদেশের ইতিহাসের একমাত্র কোয়ালিটিফুল লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখন ক্যারিয়ার শুরুতে আশা দেখালেও বর্তমান সময়ে তিনি যেন শুধু এক আক্ষেপের নাম। বোর্ডের অযত্ন এর সাথে নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য আজ তিনি ঘরোয়া লিগেও নিয়মিত নাহ। বর্তমানে জাতীয় দলের সাথে যুক্ত থাকা আমিনুল ইসলাম বিপ্লব ঘরোয়াতেও নিয়মিত খেলার সুযোগ পান নাহ। পাবেন ই বা কি করে তিনি যে ছিলেন পার্ট টাইম লেগ স্পিনার কিন্তু জাতীয় দলে এসে হয়ে গেছেন স্ট্রাইক বোলার। এছাড়াও লেগ স্পিনার হিসবে জাতীয় দলের রাডারে আছেন রিশাদ এবং আফ্রিদি। কিন্তু নিয়মিত ঘরোয়া খেলার সুযোগ পান না কেউ ই।
বর্তমান সময়ে লেগ স্পিনার এর চাহিদা তুংগে থাকলেও বিসিবি ব্যর্থ হয়েছে লেগ স্পিনারদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে যার ফলে ফ্ল্যাট পিচ গুলোতে একজন স্পিনিং উইকেট টেকার আফসোস প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। একজন মানসম্পন্ন লেগ স্পিনার বের হয়ে আসলে যেরকম জাতীয় দল যেমন পাবে একজন স্পিন উইকেট টেকার তেমনি অন্তত নেট প্র্যাকটিস এর মাধ্যমে হলেও ব্যাটসম্যান দের লেগ স্পিন জুজু কাটবে। কারণ স্পিন বোলিং যদি ক্রিকেটের আর্ট হয়ে থাকে তাহলে লেগ স্পিন হচ্ছে সেই আর্টের সবচেয়ে সুন্দর ও অমায়িক তুলির আচড়।